নবাবগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধিঃ ঢাকার নবাবগঞ্জে ব্যক্তি উদ্যোগে একটা কক্ষে কিছু বই নিয়ে শুরু হয়েছিল ‘চাঁদের পাহাড় বুক ক্যাফে’র যাত্রা। এক বছর আগে বিজয় দিবসে শুরু করা পাঠাগারটি প্রথম বর্ষপূর্তি করেছে গত সোমবার (১৬ ডিসেম্বর)। শিশুদের ছবি আঁকা উৎসব, বই পড়ার একাল-সেকাল নিয়ে আলোচনা, আবৃত্তি, নৃত্য আর গানের মধ্যদিনে দিনটিকে উদ্যাপন করেছে পাঠাগারটি।
বান্দুরা হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজে অদূরে মোলাশীকান্দা এলাকায় নিজের বাড়ি ঘেঁষা সড়কের পাশের একটি কক্ষে চাঁদের পাহাড় বুক ক্যাফের প্রতিষ্ঠাতা কবি জেমস আনজুস। গত সোমবার সকালে উপজেলার বান্দুরা ইউনিয়নের মোলাশীকান্দা উদ্যোগী সংঘ (ক্লাব) প্রাঙ্গণে এর প্রথম বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান হয়।
চাঁদের পাহাড় বুক ক্যাফের উপদেষ্টা ও গল্পকার খোকন কোড়ায়ায় সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন রাজধানী থেকে আসা লেখক, কবি, গবেষক, শিল্পীরা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক কবি আমিনুর রহমান সুলতান। অনুষ্ঠানে সাহিত্য আসরের ‘বই পড়ার সেকাল-একাল’ পর্বে প্রবন্ধ পাঠ করেন গল্পকার ও সাংবাদিক অলাত এহ্সান। তার আলোচনায় নিজের অভিজ্ঞতায় গত শতাব্দির নব্বইয়ে দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত নবাবগঞ্জে পাঠ্যবইয়ের বাইরে মননশীল পাঠের অবস্থা, বিদ্যালয়ের পাঠাগার ও ম্যাগাজিন চর্চার ইতিহাস তুলে ধরেন।
গল্পকার অলাত এহ্সান বলেন, ‘জহির রায়হানের “হাজার বছর ধরে” উপন্যাসে আমরা দেখি একটা পুকুর কেন্দ্র করে একটি গ্রামের পত্তন হচ্ছে। গ্রামায়ণের ইতিহাসই এমন— নদী, পুকুর, বনের পাশে গ্রাম গড়ে উঠেছে। একটা বড় বটগাছের নিচে বাজার বসছে। তেমনি একটা লাইব্রেরি, বুক ক্লাব গ্রামের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। একারণেই চাঁদের পাহাড় বুক ক্যাফে গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর বিজয় দিবসের দিনে এর সূচনা হয়েছে, আজ তার প্রথম বর্ষপূর্তি হলো। আমাদের উচিত হবে একে সমৃদ্ধ করা, বাড়িয়ে তোলা।’
নবাবগঞ্জের সন্তান গল্পকার এহ্সান বলেন, ‘পৃথিবী নিজের মতো এগিয়ে যাবে; সেই যাত্রায় নিজের যোগ্যতা নিয়ে আমরা কতটা অংশগ্রহণ করতে পারি, সেই শুভবোধ তৈরি করতে পারে বই। প্রতিটি বাড়িতে মননশীল বইয়ের ছোট্ট সংগ্রহ থাকলে, বড়দের পাঠাভ্যাস থাকলে শিশুরাও পাঠে আগ্রহী হবে। যে শিশু পাঠ্যবইয়ের বাইরেও পড়তে পাড়ে, তার ভবিষ্যৎ উৎকর্ষ নিয়ে অভিভাবকদের ভাবতে হয় না। বহু বই পড়া মানুষকে হীন আকাঙ্ক্ষায় উস্কে দিয়ে সমাজে অনিষ্ঠ করা সম্ভব হবে না।’
আল হাসান সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন কথাসাহিত্যিক-চিকিৎসক তানজিনা হোসেন, লেখক মুম রহমান, কবি সাকিরা পারভিন, কবি পিয়াস মজিদ, নির্মাতা ও অভিনেত্রী লুসি তৃপ্তি গমেজ। ছবি আঁকা পর্বে শিশু থেকে অষ্টম শ্রেণির পর্যন্ত ৮৮ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। অনুষ্ঠানে স্থানীয় শিল্পী ওয়াসেক বাউল-এর গাওয়া লালনগীতি ‘দয়াল নিতাই কাউরে ছেড়ে যাবে না’ গানটি সবাইকে বিমোহিত করে।
আলোচনায় মুম রহমান বলেন, ‘বাড়িতের রান্না করেন একজন নারী, কিন্তু বাজার করেন একজন পুরুষ, যিনি রান্নার উপাদনা সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখেন না। তেমনি বইমেলায় শিশুদেরও মন-মনন-আগ্রহ কেমন, সেই দিকে নজর না দিয়ে বড়রা চিরায়তন (ক্লাসিক বই) বই বাছাই করে দিলে, শিশুর পাঠ আগ্রহ মরে যাবে। শিশুদের পছন্দের বই দিয়ে পাঠ শুরু করলে একদিন চিরায়ত বইয়ের পাঠেও উৎসাহিত হবে।’
কবি সাকিরা পারভিন নিজের কবিতা পাঠ ও গানের মধ্যদিয়ে দর্শকদের আপ্লুত করেন। বান্দুরা সন্তান অভিনেত্রী লুসি তৃপ্তি গমেজ পাঠাগার কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক চর্চা বৃদ্ধির আহ্বান জানান। কথাসাহিত্যিক তানিজিনা হোসেন পার্বত্য চট্টগ্রামের এক নিভৃত গ্রামে তার লেখার খুদের পাঠক পাওয়া কথা জানিয়ে বলেন, সাহিত্য সীমাহীন, স্থানহীন, শিশুকে তার কাছে আসতে দিতে হবে। লোকশিল্পবিদ আমিনুর রহমান সুলতান নবাবগঞ্জ কেন্দ্রিক তার গবেষণার প্রসার ও নতুন বই প্রকাশের কথা বলে। তিনি নিজ উদ্যোগে চাঁদের পাহাড়ে রিকশা আর্ট ক্যাম্পেইন আয়োজনের ঘোষণা দেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন বুক ক্যাফের প্রতিষ্ঠাতা জেমস আনজুস। শেষে ছবি আঁকা উৎসবে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরস্কার তুলে দেন অতিথিরা।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply